বুধবার, ১২ মার্চ, ২০২৫

পাপ কাহাকে কহে?

 পাপ কাহাকে কহে?

১। যাহাতে অপরের মনে কষ্ট হয়, সুতরাং সহানুভূতি দ্বারা তোমারও হয়, তাহাকে পাপ বলে।

যে আত্মা যত পাপভারে আক্রান্ত, তাহারই পাপকর কার্য্যে তত অল্প ক্লেশ বোধ হয়, সুতরাং লঘুতর পাপে ঘোর পাপীদিগের যে ক্লেশ হয়, তাহা তাহারা অনুভবনীয়রূপে বোধ করিতে পারে না। এমন কি সাতিশয় পাপরাশিতে অভিভূত হইলে, গুরুতর পাপের ক্লেশও অনুভব করিতে পারে না। সুতরাং একবার নিষ্পাপ হইতে না পারিলে আর সমস্ত পাপ অনুভব করিবার শক্তি জন্মে না।

জগতে সকল ব্যক্তি সকল কার্য্যে সমান অধিকারী নহে। দেখ, যে মাতৃদুগ্ধ ব্যতীত শিশুর জীবন রক্ষা সুকঠিন, সেই মাতৃদুগ্ধ আবার যুবার পানীয় নহে। অপর, যুবা যে মৎস্য মাংসাদি দ্বারা শরীর সবল করিয়া থাকেন, শিশুর পক্ষে তাহা ভক্ষণীয়ই নহে। অন্যদিকে দেখ, যে ব্যক্তি বহুকাল আকরের অন্ধকারময় স্থানে বাস করে, একেবারে সূর্য্যালোকে-সমুদ্ভাসিত স্থানে উন্মীলিতনেত্রে গমন, তাহার পক্ষে অসম্ভব। অর্থাৎ তথায় গমন করিলেও তাহাকে নিমীলিতনেত্রে থাকিতে হইবে। অপর, নিরন্তর আলোকরাশিতে ভ্রমণশীলও যদি অন্ধকারময় স্থানে গমন করেন, তবে তিনিও প্রথমে কিছুই দেখিতে পাইবেন না। ইত্যাদি। বিষয়ান্তরে দেখ, সুস্থ ব্যক্তির পক্ষে যেরূপ কার্য্য করা কর্ত্তব্য, অসুস্থের পক্ষে তাহা অকর্ত্তব্য। সুস্থদিগের মধ্যেও ক্ষমতাবিশেষে বিভিন্ন প্রকার কার্য্য করা উচিত। বস্তুতঃও যে ব্যক্তির যতদূর ক্ষমতা আছে, তদনুরূপ কার্য্য না করিলে বা তদপেক্ষা অধিক কার্য্য করিলেই জীবাত্মার কষ্ট হয়, সুতরাং ঐ সমস্তই পাপ। এই রূপেই জীবাত্মার পাপ হয়।
প্রথমতঃ, জন্মগ্রহণকালে পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ ও বৃদ্ধপ্রপিতামহ এবং মাতা, মাতামহ ও প্রমাতামহ এই সাত জনের ও পিতামহী, মাতামহী প্রভৃতি পাঁচ জনের যত পাপ থাকে, তত পাপ স্বীকার করিয়া গর্ভে প্রবিষ্ট হইতে হয়। কিন্তু যদি সৌভাগ্যক্রমে মাতাপিতা নিষ্পাপ অর্থাৎ পূর্ব্বতনগণের পাপ হইতে মুক্ত হইয়া থাকেন। তবে গর্ভস্থের পূর্ব্বোক্ত পাপ হয় না। কিন্তু তাঁহাদিগের যদি অন্য পাপ থাকে, তবে তাহা হয়। দ্বিতীয়তঃ, স্বকৃত পাপ অর্থাৎ পাপকর কার্য্য সম্পাদনে যে পাপ হয়, তাহাই। এই দুই প্রকারে এবং কতিপয় সূক্ষ্মকারণে পাপস্পর্শ হয়।


পাপ এর শাস্তি
রূপক: পাপ এর শাস্তি

পাপের প্রকৃত প্রায়শ্চিত্ত আত্মগ্নানি। যেমন পাপ, তদ্রূপ আত্মগ্লানি হওয়া আবশ্যক। নতুবা পাপ হইতে সম্পূর্ণ মুক্তি লাভ হয় না। মনে কর, আত্মা তৈল ও সল্তাদ্বারা জ্বালিত দীপ। (মৃৎপাত্রটী যেন অসীমরূপে বিস্তৃত হইতে পারে অর্থাৎ উহার এরূপ নির্ম্মাণ যে, যত তরল দ্রব্যই উহাতে দেও না কেন, ততই উহা ধারণ করিতে পারে।) আর তৈল উহার হিতকারী বলিয়া পুণ্য, ও জল উহার শিখার তেজোহ্রাসকারক বলিয়া পাপ। এক্ষণে দেখ, ঐ দীপে জল পড়িলে, যতক্ষণ না জল দূরীভূত হইবে, ততক্ষণ উহা স্থির হইতে পারে না, তদ্রূপ আত্মার পাপমুক্তি না হইলে, আত্মাও স্থির হইতে পারে না। আর প্রদীপে জল পড়িলে, জলের পরিমাণ ও শিখার প্রবলতা অনুসারে, অধিক বা অল্পকাল ও অধিক বা অল্পবেগে শিখার চাঞ্চল্য হয়, তদ্রূপ আত্মার পক্ষেও জানিবে। ইত্যাদি।


কিন্তু যেমন ঐ প্রদীপের জলভাগ উপায়বিশেষ দ্বারা ফেলাইয়া দিলে আর শিখার কোনও চাঞ্চল্য হয় না, তদ্রূপ অন্য কোনও ক্ষমতাপন্ন ব্যক্তি পাপগ্রহণ করিলেও পাপ হইতে মুক্ত হওয়া যায়। অতএব পাপ হইতে মুক্তির ২য় উপায় ক্ষমতাপন্ন-কর্ত্তৃক পাপগ্রহণ। এতদ্ভিন্ন স্বর্গীয় বাক্ সিদ্ধিপ্রাপ্ত সাধকদ্বারাও পাপ হইতে মুক্তি হইতে পারে। ইত্যাদি, ইত্যাদি।


মঙ্গলবার, ১১ মার্চ, ২০২৫

পুনর্জন্ম কি? উহা কাহার হয়?

 পুনর্জন্ম কি? উহা কাহার হয়?


পরলোকগত আত্মাদিগের মধ্যে কেহ কেহ পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন। ইহাকেই পুনর্জন্ম কহে।

পুনর্জন্ম
জন্ম হতে মৃত্যু, পুনরায় আত্মার জন্ম

পুনর্জন্ম সকল আত্মারই যে হইবে, এরূপ নহে, উহা আত্মাদিগের স্ব স্ব ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। যে সকল ব্যক্তি আয়ুঃসত্ত্বে আদিম দেহ ত্যাগ করেন, অথবা যে সকল ব্যক্তি সম্পূর্ণ আয়ুঃ ভোগ করিয়া গমন করিয়াও উপায়বিশেষ দ্বারা পরলোকে আয়ুঃ প্রাপ্ত হন, তাঁহাদিগেরই পুনর্জন্ম হইতে পারে। অন্য কাহারও হইতে পারে না। আর আয়ুবিশিষ্ট বা আয়ুঃপ্রাপ্ত মাত্রেরই যে পুনর্জন্ম হইবে, তাহাও নহে। যে সকল আত্মা পরলোকে স্ব স্ব কর্ত্তব্য কর্ম্ম (পাপক্ষয় ও গুণসাধন) করিয়া উঠিতে পারেন না, অথবা যাঁহারা পরলোকে গুণের অভাব প্রভৃতি নিবন্ধন অধীর হন, সাধারণতঃ তাঁহারাই পুনর্জন্ম লইয়া থাকেন। এতদ্ভিন্ন উন্নত আত্মারাও কখনও কখনও সবিশেষ কারণবশতঃ পুনরায় জন্মগ্রহণ করিয়া থাকেন। সুতরাং পুনর্জন্মের বিষয়ে সবিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিলে বোধ হইবে যে, উহা আত্মাদিগের ইচ্ছাধীন।


পুণ্য কাহাকে কহে?

পুণ্যের পুরস্কার কি?

যেমন পাপ করিলে তাহার ফল তমোময় আত্মগ্লানি অবশ্যই উপস্থিত হইবে, তদ্রূপ পুণ্য করিলে তাহার ফল সত্ত্বময় বা জ্যোতির্ম্ময় আত্মপ্রসাদও অবশ্যই উপলব্ধ হইবে। অতএব পাপের তিরস্কার অবশ্যম্ভাবিনী আত্মগ্লানির ন্যায়, পুণ্যের পুরস্কারও অবশ্যম্ভাবী আত্মপ্রসাদ।

পুণ্যের পুরস্কার

এ পর্য্যন্ত যাহা যাহা লিখিত হইয়াছে, তাহা পাঠ করিয়া পাঠকের মনে এই সংশয় উপস্থিত হইতে পারে যে, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে লিখিত হইয়াছে যে, উপাসনাদ্বারা পাপ হইতে মুক্তি হয় এবং এক্ষণে লিখিত হইল যে, আত্মগ্লানিই পাপের প্রায়শ্চিত্ত। যদি কোনও ব্যক্তির উপাসনাব্যতীতও আত্মগ্লানি হয়, তবে কি সে পাপ হইতে মুক্ত হইবে না? ইহার উত্তর এই যে, উপাসনাব্যতীত উপযুক্ত আত্মগ্লানি হইতে পারে না। যেমন কলসীতে জল পূরিবার সময়ে, উহা অধিক পূর্ণ হইবার পরে জল পড়িয়া যায়, অথবা জলের বেগে কাইত (কা’ত) হইলেও কতকটা জল পড়িয়া যায়, কিংবা বেগে কলসীর মধ্যে জল পড়িতে আরম্ভ হইলে ছিটা ফোঁটা আকারে কিঞ্চিৎ জল পড়িয়া যায়; কিন্তু কলসী একেবারে উপুড় না হইলে সমস্ত জল কখনই পড়িয়া যায় না। তদ্রূপ উপাসনা-ব্যতীত যে আত্মগ্লানি হয়, তাহাতে কিঞ্চিৎ পাপক্ষয় হইতে পারে বটে, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে হয় না। দেখ, অনন্ত গুণধামের গুণরাশি স্মরণ না করিলে, স্বীয় হেয়ত্ব উপযুক্তরূপে বোধ হয় না, সুতরাং সমুচিত আত্মগ্লানিও হইতে পারে না। অতএব পাপ হইতে মুক্ত হইতে হইলে, উপাসনা করা নিতান্ত আবশ্যক। অন্যথা, উপযুক্ত আত্মগ্লানি না হওয়াতে সম্পূর্ণ পাপ-মুক্তি লাভও হয় না।

জ্যোতি ও অন্ধকারের ন্যায় পাপ ও পুণ্য পরস্পর বিপরীত-ধর্ম্মাবলম্বী পদার্থ হইলেও উহারা একই পদার্থকে অবলম্বন করিয়া থাকে। যেমন দিবার আলোক ও রাত্রির অন্ধকার একই দিবসকে (অহোরাত্রকে) অবলম্বন করিয়া রহে, তদ্রূপ পুণ্য ও পাপও একই পদার্থাবলম্বনে উৎপন্ন হয়। এজন্য তত্ত্বদর্শীরা উহাদিগকে একজাতীয় কহেন।