পাপ কাহাকে কহে?
১। যাহাতে অপরের মনে কষ্ট হয়, সুতরাং সহানুভূতি দ্বারা তোমারও হয়, তাহাকে পাপ বলে।
যে আত্মা যত পাপভারে আক্রান্ত, তাহারই পাপকর কার্য্যে তত অল্প ক্লেশ বোধ হয়, সুতরাং লঘুতর পাপে ঘোর পাপীদিগের যে ক্লেশ হয়, তাহা তাহারা অনুভবনীয়রূপে বোধ করিতে পারে না। এমন কি সাতিশয় পাপরাশিতে অভিভূত হইলে, গুরুতর পাপের ক্লেশও অনুভব করিতে পারে না। সুতরাং একবার নিষ্পাপ হইতে না পারিলে আর সমস্ত পাপ অনুভব করিবার শক্তি জন্মে না।
জগতে সকল ব্যক্তি সকল কার্য্যে সমান অধিকারী নহে। দেখ, যে মাতৃদুগ্ধ ব্যতীত শিশুর জীবন রক্ষা সুকঠিন, সেই মাতৃদুগ্ধ আবার যুবার পানীয় নহে। অপর, যুবা যে মৎস্য মাংসাদি দ্বারা শরীর সবল করিয়া থাকেন, শিশুর পক্ষে তাহা ভক্ষণীয়ই নহে। অন্যদিকে দেখ, যে ব্যক্তি বহুকাল আকরের অন্ধকারময় স্থানে বাস করে, একেবারে সূর্য্যালোকে-সমুদ্ভাসিত স্থানে উন্মীলিতনেত্রে গমন, তাহার পক্ষে অসম্ভব। অর্থাৎ তথায় গমন করিলেও তাহাকে নিমীলিতনেত্রে থাকিতে হইবে। অপর, নিরন্তর আলোকরাশিতে ভ্রমণশীলও যদি অন্ধকারময় স্থানে গমন করেন, তবে তিনিও প্রথমে কিছুই দেখিতে পাইবেন না। ইত্যাদি। বিষয়ান্তরে দেখ, সুস্থ ব্যক্তির পক্ষে যেরূপ কার্য্য করা কর্ত্তব্য, অসুস্থের পক্ষে তাহা অকর্ত্তব্য। সুস্থদিগের মধ্যেও ক্ষমতাবিশেষে বিভিন্ন প্রকার কার্য্য করা উচিত। বস্তুতঃও যে ব্যক্তির যতদূর ক্ষমতা আছে, তদনুরূপ কার্য্য না করিলে বা তদপেক্ষা অধিক কার্য্য করিলেই জীবাত্মার কষ্ট হয়, সুতরাং ঐ সমস্তই পাপ। এই রূপেই জীবাত্মার পাপ হয়।
প্রথমতঃ, জন্মগ্রহণকালে পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ ও বৃদ্ধপ্রপিতামহ এবং মাতা, মাতামহ ও প্রমাতামহ এই সাত জনের ও পিতামহী, মাতামহী প্রভৃতি পাঁচ জনের যত পাপ থাকে, তত পাপ স্বীকার করিয়া গর্ভে প্রবিষ্ট হইতে হয়। কিন্তু যদি সৌভাগ্যক্রমে মাতাপিতা নিষ্পাপ অর্থাৎ পূর্ব্বতনগণের পাপ হইতে মুক্ত হইয়া থাকেন। তবে গর্ভস্থের পূর্ব্বোক্ত পাপ হয় না। কিন্তু তাঁহাদিগের যদি অন্য পাপ থাকে, তবে তাহা হয়। দ্বিতীয়তঃ, স্বকৃত পাপ অর্থাৎ পাপকর কার্য্য সম্পাদনে যে পাপ হয়, তাহাই। এই দুই প্রকারে এবং কতিপয় সূক্ষ্মকারণে পাপস্পর্শ হয়।
![]() |
রূপক: পাপ এর শাস্তি |
পাপের প্রকৃত প্রায়শ্চিত্ত আত্মগ্নানি। যেমন পাপ, তদ্রূপ আত্মগ্লানি হওয়া আবশ্যক। নতুবা পাপ হইতে সম্পূর্ণ মুক্তি লাভ হয় না। মনে কর, আত্মা তৈল ও সল্তাদ্বারা জ্বালিত দীপ। (মৃৎপাত্রটী যেন অসীমরূপে বিস্তৃত হইতে পারে অর্থাৎ উহার এরূপ নির্ম্মাণ যে, যত তরল দ্রব্যই উহাতে দেও না কেন, ততই উহা ধারণ করিতে পারে।) আর তৈল উহার হিতকারী বলিয়া পুণ্য, ও জল উহার শিখার তেজোহ্রাসকারক বলিয়া পাপ। এক্ষণে দেখ, ঐ দীপে জল পড়িলে, যতক্ষণ না জল দূরীভূত হইবে, ততক্ষণ উহা স্থির হইতে পারে না, তদ্রূপ আত্মার পাপমুক্তি না হইলে, আত্মাও স্থির হইতে পারে না। আর প্রদীপে জল পড়িলে, জলের পরিমাণ ও শিখার প্রবলতা অনুসারে, অধিক বা অল্পকাল ও অধিক বা অল্পবেগে শিখার চাঞ্চল্য হয়, তদ্রূপ আত্মার পক্ষেও জানিবে। ইত্যাদি।
কিন্তু যেমন ঐ প্রদীপের জলভাগ উপায়বিশেষ দ্বারা ফেলাইয়া দিলে আর শিখার কোনও চাঞ্চল্য হয় না, তদ্রূপ অন্য কোনও ক্ষমতাপন্ন ব্যক্তি পাপগ্রহণ করিলেও পাপ হইতে মুক্ত হওয়া যায়। অতএব পাপ হইতে মুক্তির ২য় উপায় ক্ষমতাপন্ন-কর্ত্তৃক পাপগ্রহণ। এতদ্ভিন্ন স্বর্গীয় বাক্ সিদ্ধিপ্রাপ্ত সাধকদ্বারাও পাপ হইতে মুক্তি হইতে পারে। ইত্যাদি, ইত্যাদি।